Table of Contents

বিয়ে ও তালাক: সামাজিক, ধর্মীয় এবং আইনগত দিক

বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন এবং একই সাথে ধর্মীয় বিষয়। এটি পুরুষ ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান, নির্ভরশীলতা, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের সম্পর্ক তৈরি করে। এর মাধ্যমে তারা পরিবার গঠন, সন্তান জন্মদান এবং বংশবিস্তার করার বৈধ অধিকার লাভ করে। তবে, বিয়ে শুধু দুটি মানুষের সম্পর্ক নয়; এটি দুই পরিবারের মধ্যেও একতা ও বন্ধন তৈরি করে।

তালাকের কথা সাধারণত মানুষ কল্পনাও করতে চায় না। তবে নানা কারণে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা আজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে নারীরা আগের মতো অনেক ক্ষেত্রে একতরফা মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থেকে সরে আসছে। অতি সাধারণ বিষয় নিয়েও অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে সমস্যা তৈরি হয়, যা তালাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম:

 

১. ডিভোর্সের অধিকার ও প্রক্রিয়া:

স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই তালাক দেওয়ার অধিকার রাখেন। বিয়ে নিবন্ধনের সময় স্ত্রীকে যদি ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া থাকে, তাহলে তিনি সরাসরি তালাক দিতে পারেন। যদি এই অধিকার না দেওয়া থাকে, তবে স্ত্রী মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুসারে আদালতে আবেদন করতে পারেন।

২. পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক (খুলা):

যদি স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক দেন, তাহলে স্ত্রী তার প্রাপ্য দেনমোহর ও ভরণপোষণ পান। তালাকের পর স্ত্রী নতুন করে বিয়ে করতে চাইলে ইদ্দতকালীন তিন মাস অতিবাহিত করতে হয়। যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, তবে সন্তানের জন্মের পর তালাক কার্যকর হবে।

৩. তালাক নোটিশ ও রেজিস্ট্রেশন:

তালাক কার্যকর করার আগে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে নোটিশ পাঠাতে হয়। চেয়ারম্যান বা মেয়র ৩০ দিনের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। যদি সমঝোতা না হয়, তবে নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়।

৪. হিন্দু ও খ্রিস্টান আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ:

হিন্দু ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। দাম্পত্য সমস্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণের জন্য দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হয়।

খ্রিস্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদ একটি জটিল প্রক্রিয়া। ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯ অনুসারে জেলা জজ বা হাইকোর্টে আবেদন করতে হয়।

বিয়েসংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তি:

১. ডিভোর্স ছাড়াই পুনরায় বিয়ে করা দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।
২. প্রতারণার মাধ্যমে বা আগের বিবাহ গোপন করে বিয়ে করলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
৩. অন্যের স্ত্রীকে বিবাহ করলে তা দণ্ডবিধি ৪৯৭ ধারা অনুসারে ব্যভিচার হিসেবে বিবেচিত হয়।

ডিভোর্স কিভাবে কার্যকর হয়?

স্ত্রী তার স্বামীকে বিবাহ বিচ্ছেদের/ডিভোর্সের প্রস্তাব দেন এবং বিনিময়ে মোহরানার কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ মওকুফ করতে রাজি হন। যদি স্বামী এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তবে তালাক কার্যকর হয়। যদি স্বামী সম্মতি না দেন, তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে খুলার আবেদন করতে পারেন।

মিউচুয়াল ডিভোর্স কি?

মিউচুয়াল ডিভোর্স হল ডিভোর্স যেখানে পত্নী উভয়ই তাদের বিয়ে শেষ করতে পারস্পরিকভাবে সম্মত হন এবং বিবাহবিচ্ছেদের জন্য একক পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সাথে পারিবারিক আদালতে যান যেখানে পক্ষগুলি তাদের পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদের মীমাংসা নিয়ে আদালতে যায়।

স্ত্রী কি স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারে?

তালাক স্বামী তার স্ত্রীকে দিতে পারে। স্বামী যদি তার স্ত্রীকে নিজের উপর তালাক গ্রহণ করার অধিকার দিয়ে থাকে, শরীয়তের ভাষায় এ অধিকার প্রদানকে বলে ‘তাফওয়ীয’। সে ক্ষেত্রে স্বামীর দেওয়া শর্ত অনুযায়ী স্ত্রী নিজের উপর তালাক গ্রহণ করতে পারবে। স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না।

ডিভোর্স দিলে কি দেনমোহর দিতে হয়?

স্ত্রী তালাক দিলেও দেনমোহর পাবেন। বিবাহবিচ্ছেদ যেভাবেই হোক, স্ত্রী অবশ্যই দেনমোহর পাবেন। তবে নিকাহনামায় কোনো উশুল লেখা থাকলে বকেয়া টাকা পাবেন। বিয়ে যত দিন চলমান থাকবে, তত দিন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে উপযুক্ত পরিমাণে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন।

ডিভোর্স দিতে কি সাক্ষী লাগে?

তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য কোন সাক্ষী উপস্থিত থাকা শর্ত নয়। এমনকি স্ত্রী উপস্থিত থাকা বা তাকে তালাকের কথা শোনানোও শর্ত নয়। স্বামী তালাকের বিষয়টি যে কোন মাধ্যমে স্ত্রীকে জানালে তালাক কার্যকর হবে। এভাবে তিন তুহরে তিন তালাক দিলে স্ত্রী স্থায়ী (বায়েন) তালাক হয়ে যাবে।

ডিভোর্স হলে সন্তান কে পাবে?

ইসলামি ফেকাহগ্রন্থ রাদ্দুল মুহতার যা ফতোয়ায়ে শামি নামে বিখ্যাত এই কিতাবের ৫ম খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় আছে, শরিয়তের বিধান হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ছেলে সাত বছর এবং মেয়ের বয়স নয় বছর পর্যন্ত সন্তান তার মায়ের কাছে থাকবে। কিন্তু তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব পিতার ওপর।

বাচ্চা কত বছর পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে?

ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের ভালোর জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে।

মামলার স্থান ও পদ্ধতি:

বিয়ে সংক্রান্ত যেকোনো মামলা পারিবারিক আদালতে করা যায়। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে মামলা পরিচালনা সম্ভব না হলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদন করা যেতে পারে।

ডিভোর্স দিতে কত দিন সময় লাগে?

বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া না করেন, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হবে। বাংলাদেশের আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ স্থানীয় চেয়ারম্যানকেও জানাতে হয়। চেয়ারম্যানের অফিসে যেদিন নোটিশটি জমা দেওয়া হবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন গণনা শুরু হবে।

তালাক দিতে কত টাকা খরচ হয়?

একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার তালাক নিবন্ধনের জন্য বিধিমালা অনুযায়ী এক হাজার টাকা।

যারা কোন ধর্ম পালন করে না, তাদের বিবাহ বিচ্ছেদঃ

যারা খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন ধর্ম অনুসরণ করেন না, বিশেষ বিবাহ আইনটি তাদের জন্য। এই আইনের অধীনে বিয়ে করা দম্পতিরা ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন। এজন্য আদালতে আবেদন করতে হবে এবং আদালতের অনুমতিক্রমে ডিভোর্স প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার আবেদন করতে পারবেন। আর স্ত্রী স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার আবেদন করতে পারবেন ব্যাভিচার, অন্য নারীকে বিয়ে, নির্যাতনসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে।

স্বামী বা স্ত্রী যে পক্ষই ডিভোর্সের আবেদন করুক না কেন, আদালতে তাদের আবেদনের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। সব তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে আদালত রায় দেবেন।

বাংলাদেশে তালাকের পর স্ত্রী কি সম্পত্তি দাবি করতে পারবে?

যখনই আদালত বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্ত্রীর ব্যভিচারের জন্য বিচারিক বিচ্ছেদের ডিক্রি ঘোষণা করে, যদি আদালতের কাছে হাজির করা হয় যে স্ত্রী কোনও সম্পত্তির অধিকারী, আদালত যদি উপযুক্ত মনে করেন, এই ধরনের নিষ্পত্তির আদেশ দিতে পারেন।

কি কি কারণে ডিভোর্স দেওয়া যায়?

১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী কী কী কারণে স্বামীকে তালাক দিতে পারে তা উল্লেখ করা হয়েছে । কারণগুলো হল: ১. যদি চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকে। ২. দুই বছর স্বামী স্ত্রীর খোরপোশ দিতে ব্যর্থ হয়। ৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশি কারা-দণ্ডাদেশ হলে। ৪. স্বামী কোনও যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় ধরে (তিন বছর) দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে। ৫. স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম থাকলে। ৬. স্বামী যদি দুই বছর পাগল থাকে অথবা কোনও গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে। ৭. স্বামীর ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতার কারণেও স্ত্রী তালাক দিতে পারে।

যে কোন যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। তবে অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। যে যে কারণে তালাক দেওয়া যাবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মন ও মতের অমিল, চারিত্রিক সমস্যা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ও আর ফিরে না আসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করা ইত্যাদি।

সংসার করব না বললে কি তালাক হয়ে যায়?

কি কি কারণে ডিভোর্স দেওয়া যায়?
যে যে কারণে তালাক দেওয়া যাবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মন ও মতের অমিল, চারিত্রিক সমস্যা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ও আর ফিরে না আসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করা ইত্যাদি।

কাবিনের টাকা না দিয়ে ডিভোর্স দিলে শাস্তি কি?

পরিশোধ না করলে ১ মাস কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। স্ত্রী ইচ্ছা করলে তার স্বামী বা স্বামীর উত্তরাধিকারীগণের পক্ষে আংশিক বা সম্পূর্ণ দেনমোহর মওকুফ করে দিতে পারে। হতে পারে তা প্রতিদান ব্যতিরেকে। এজাতীয় হ্রাস বা মওকুফ অবশ্যই স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতিতে হতে হবে।

বাংলাদেশে ডিভোর্সের হার কত?

বর্তমানে দেশে তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছিন্নের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক চার শতাংশ। পুরুষের তুলনায় নারীরা তালাক ও বিচ্ছেদের পথে বেশি এগিয়েছেন। বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, খুলনা বিভাগের নারীরা ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছিন্নের পথে এগিয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রাজশাহী বিভাগ।

ডিভোর্স সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?

বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে হালাল বিষয়ের মধ্যে তালাকের চেয়ে অধিকতর ঘৃণিত আর কিছু নেই। ‘ (আবু দাউদ : ২১৭৭)। আল্লামা তীবি (রহ.) বলেন, তালাক ইসলামে বৈধ হলেও তা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, কেননা শয়তানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো।

 

বিয়ে একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এটি মানুষের জীবনে শান্তি, স্থিতি ও সম্প্রীতি আনতে পারে। তাই ডিভোর্সের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একাধিকবার ভেবে, পরিবারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। ডিভোর্স শুধু ব্যক্তি নয়, একটি পরিবার ও সমাজকেও প্রভাবিত করে। সঠিক মানসিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে দাম্পত্য জীবনে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।