আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ

আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা হয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের ধরণ এবং প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে।

বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া

১. মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ

মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ ইসলামী আইন ও বাংলাদেশের পারিবারিক আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। তালাক, খুলা, এবং সালিশের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে।

তালাকের প্রক্রিয়া (স্বামীর দ্বারা):
  1. স্বামী তালাক ঘোষণা করবেন মৌখিক বা লিখিতভাবে।
  2. লিখিত তালাকের নোটিশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভায় জমা দিতে হবে।
  3. চেয়ারম্যান তালাকের বিষয়ে উভয় পক্ষকে অবহিত করে সালিশের ব্যবস্থা করবেন।
  4. ৯০ দিনের মধ্যে আপস না হলে তালাক কার্যকর হবে।
খুলা (স্ত্রীর উদ্যোগে বিচ্ছেদ):
  • স্ত্রী বিচ্ছেদের জন্য স্বামীর কাছে আবেদন করেন।
  • পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।
  • স্ত্রী কিছু ক্ষতিপূরণ বা দেনমোহরের অর্থ স্বামীকে ফেরত দিতে পারে।

২. হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ

  • হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৪৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহের জন্য কোনও সাধারণ বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান নেই।
  • কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে বিবাহ অকার্যকর ঘোষণা করা যেতে পারে, যেমন প্রতারণা, অসামঞ্জস্য বা সঙ্গমে অক্ষমতা।

৩. খ্রিস্টান আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ

  • খ্রিস্টান বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৮৬৯ অনুসারে, স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়া, নিষ্ঠুরতা, অথবা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অক্ষমতা প্রমাণ করে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন।

৪. বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ

যারা ধর্মনিরপেক্ষভাবে বিয়ে করেছেন বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিবাহ হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবাহ আইন প্রযোজ্য। এই আইনে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বা আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ বিভাগীয় মামলা কি

পদ্ধতি:

  1. আদালতে বিচ্ছেদের আবেদন জমা দিন।
  2. আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত নেবে।
  3. সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং সম্পত্তির বণ্টনের বিষয়গুলোও আদালত বিবেচনা করবে।

তালাকের উচ্চারণ ও প্রক্রিয়া

  • মৌখিক তালাক: তালাক মৌখিকভাবে উচ্চারণ করা যায়। এটি সাধারণত স্বামীর দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং “আমি তোমাকে তালাক দিলাম” এর মতো স্পষ্ট ভাষা প্রয়োজন।
  • লিখিত তালাক: তালাক লিখিতভাবে প্রকাশিত হতে পারে, যেখানে তালাকের শর্তাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।
  • প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তালাক: সরাসরি উচ্চারণ ছাড়াও ইঙ্গিতপূর্ণ বা রূপক ভাষা ব্যবহার করা হতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে তালাকের উদ্দেশ্য প্রমাণ করা প্রয়োজন।

তালাকের শর্ত

তালাক প্রদান করার সময় নিম্নলিখিত শর্তগুলি পূরণ হতে হবে:

  • স্বামীর প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে।
  • তালাক প্রক্রিয়াটি ইচ্ছাকৃত ও স্বেচ্ছায় হতে হবে।
  • তালাকের সময় স্ত্রীর কাছে থাকা জরুরি নয়।

তিন তালাক নিয়ে বিতর্ক

  • তিন তালাক (তালাক-উল-বিদআত): ইসলামে এটি একটি অনুচিত পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত, কারণ এটি তাৎক্ষণিক বিচ্ছেদের প্রথা।
  • এটি অনেক দেশে নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, যেমন:
    • ভারতে: ২০১৯ সালে “তিন তালাক আইন” কার্যকর হয়।
    • বাংলাদেশে: তিন তালাক প্রথাটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবেচিত হয় না।

তালাকের সামাজিক প্রভাব

  • মুসলিম সমাজে তালাক প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে।
  • নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য তালাকের পর সামাজিক সমর্থন এবং নতুন জীবন শুরু করার প্রয়োজনীয়তা থাকে।

তালাকের বিরোধ নিষ্পত্তি

  • আদালত বা সালিশি বোর্ডের মাধ্যমে তালাক সম্পর্কিত কোনো বিরোধ মীমাংসা করা যায়।
  • স্ত্রী যদি মনে করেন তালাক অন্যায় বা প্রতারণামূলক, তবে তিনি আইনি সহায়তা নিতে পারেন।

তালাক এবং দেনমোহর

  • তালাকের সময় স্ত্রী তার দেনমোহর (মাহর) পরিশোধের অধিকার রাখে।
  • তালাক যদি স্বামীর পক্ষ থেকে আসে, তবে স্ত্রী পুরো দেনমোহর পাবেন।
  • স্ত্রী যদি খোলা চেয়ে তালাক নেয়, তবে দেনমোহর আংশিক বা পুরোপুরি ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত থাকতে পারে।

শিশুদের অভিভাবকত্ব (Custody)

  • তালাকের পর সন্তানের হেফাজত সাধারণত মায়ের কাছে থাকে, বিশেষ করে যদি শিশু অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়। তবে এটি পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
  • সন্তানের লালন-পালনের খরচ স্বামীর উপর বর্তায়।

আইনি সহায়তা

  • পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে সালিশ বোর্ড, পারিবারিক আদালত, অথবা ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নেওয়া যায়।
  • আইনজীবীর পরামর্শ এবং আদালতের মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।

যোগাযোগ করুনঃ 01725230535