ওয়াকফ বলতে কি বুঝায়?
- ওয়াকফ এর প্রচলিত অর্থ হচ্ছে জনসেবামূলক বা লোকহিতকর প্রতিষ্ঠান (Philanthropic Foundations) যা ইসলামী বিশ্বে হাব (habs) নামেও পরিচিত। ওয়াক্ফের সমকক্ষ কোন ইংরেজি বা বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে এটি একটি আরবী শব্দ যার অর্থ সীমিতকরণ (Confinement), বিরত রাখা বা আটক রাখা।
- ওয়াক্ফর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোন গৃহ, ভূমি বা নগদ অর্থ-সম্পদ ধর্মীয় ও জনকল্যাণে মহান আল্লাহর নামে উৎসর্গ বা দান করাকেই ওয়াক্ফ বলে।
- হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিস হতে দেখা যায় যে, যখন কোন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল আমল বা কর্ম বন্ধ হয়ে গেলেও তিনটি আমল বেঁচে থাকে। যথা- দাতব্য কাজ, দানকৃত জ্ঞান যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে এবং নেক সন্তান যারা তাঁর জন্য দোয়া করে। উক্ত তিনটি কাজের সফল বাস্তবায়নই হচ্ছে ওয়াক্ফ।
- একবার ঘোষিত/তালিকাভুক্ত ওয়াক্ফ সম্পত্তি সর্বদাই ওয়াক্ফ সম্পত্তি। কোন অবস্থাতেই তা পরিবর্তন/প্রত্যাহার করা যায় না।
ওয়াফ্ফের প্রকারভেদ
ওয়াক্ত অধ্যাদেশে ওয়াক্কের শ্রেণি বিভাগ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন বিধান নাই। তবে ইসলামী আইনবেত্তাগণ তিন ধরণের ওয়াফ্ফের কথা বলেছেন:-
- ওয়াক্ফ আল আল্লাহ- ধর্মীয় ওয়াফ্ফ
- ওয়াক্ফ আল খায়রি- দাতব্য ওয়াক্ফ যা দারিদ্র বা সমাজের জন্য
- ওয়াক্ফ আল আওলাদ- পারিবারিক ওয়াক্ফ
উল্লেখ্য আরব বিশ্বে জনগণের উপকারার্থে ওয়াক্ফ খায়রি (Waqf Khayri), পারিবারিক সম্পদ সুরক্ষার জন্য
ওয়াক্ফ আহলি (Waqf Ahli) নামক ওয়াক্ত রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ওয়াক্ফ খাস (পারিবারিক) এবং ওয়াক্ফ আম (দাতব্য) নামক দু’ধরণের ওয়াক্ফ রয়েছে।
ওয়াফ্ফের ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি বিভাগ
ব্যবহারভিত্তিক ভূমির শ্রেণি বিভাগের ন্যায় ওয়াক্ফ সম্পত্তিরও ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি বিভাজন করা হয়ে থাকে। যেমন-
- নিয়মিত প্রার্থনার স্থান মসজিদ, ইমামবাড়া।
- ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা, হেফজখানা, কুতুবখানা, এবতেদায়ী, কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র ইত্যাদি।
- কবরস্থান বা গোরস্থান।
- সমাধি স্থান- তাকিয়া, দরগাহ্ বা মাজার শরীফ ইত্যাদি।
- দাতব্য প্রতিষ্ঠান- এতিমখানা, হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র, নেশাগ্রস্থ নিরাময় কেন্দ্র ইত্যাদি।
- সরাইখানা বা আশ্রয় কেন্দ্র সরাইখানা, যাত্রী ছাউনি, এতিমখানা, বয়স্ক আশ্রয় কেন্দ্র, হজযাত্রী বিশ্রামাগার ইত্যাদি।
- ক্যাশ ওয়াক্ফ।
সুন্নী মতে, ওয়াক্ত সম্পত্তি প্রধানত দু’প্রকার। যথা- (ক) ওয়াক্ফ ফি ছাবিলিল্লাহ; ও (খ) ওয়াক্ফ আল আওলাদ
* ওয়াক্ফ ফি ছাবিলিল্লাহ (পাবলিক ওয়াক্ফ)
✓ ফি ছাবিলিল্লাহ বা আল্লাহ ওয়াস্তে দানই হচ্ছে ওয়াক্ফের মূল কথা। কোন সম্পত্তি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয়, দাতব্য বা পূণ্যলাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহ ওয়াস্তে উৎসর্গ করা হলে তাকে ‘ওয়াক্ফ ফি ছাবিলিল্লাহ’ বা ‘শুধু লিল্লাহ’ অথবা ‘পাবলিক ওয়াক্ফ’ বলে।
✓ জনস্বার্থে যার আয় ব্যবহার হয় অথবা যা মূলতঃ জনসেবায় ভূমিকা রাখে তাকে পাবলিক ওয়াক্ফ বলে। যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, বিশ্রামাগার, পানি সরবরাহের ব্যবস্থা বা এতিমখানার নামে সৃষ্ট ওয়াক্ফ ইত্যাদি।
* ওয়াক্ফ আল আওলাদ (প্রাইভেট ওয়াক্ফ)
সম্পত্তির কিছু অংশ লিল্লাহ এবং বাকি সম্পত্তি নিজ, সন্তান সন্তুতি বা বংশধরগণের ভরণপোষণের জন্য বা কেবলমাত্র ওয়াকিফ বা তাঁর পরিবারের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ওয়াক্ত করা হলে তাকে ওয়াক্ফ আল-আওলাদ অথবা শুধু আওলাদি ওয়াক্ফ বা প্রাইভেট ওয়াক্ফ বলা হয়।
* ব্যবহারিক ওয়াক্ফ
স্বাভাবিক নিয়মে মালিক পরিত্যক্ত ও অনুমতিপ্রাপ্ত না হলেও দীর্ঘ ব্যবহারের কারণে এর মালিকানা বিলুপ্ত হওয়ায় সমগ্র সম্পত্তিটি ব্যবহার দ্বারা ওয়াক্ফে পরিণত হয়। ফলে দীর্ঘদিনের ব্যবহার দ্বারা ওয়াক্ফ সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের ওয়াক্ফকে ব্যবহারিক বা রেওয়াজি ওয়াক্ফ বলে। যেমন- সিলেটস্থ হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর মাজার।
ওয়াফ্ফের প্রেক্ষাপট বা ইতিহাস
- আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স) এর সময় থেকেই ওয়াফ্ফের সূত্রপাত;
- প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) এর সহধর্মিনী বিবি খাদিজা (রা.) তাঁর সকল অর্থ সম্পদ ধর্মীয় ও জনকল্যাণে নবীজির নিকট সোপর্দ করেছিলেন;
- খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ওয়াক্ফ কার্যক্রম আরো জোরদার হয়;
- ইসলামের প্রথম যুগে হযরত ওমর (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আমর বিন আস (রাঃ) এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ওয়াক্ফ সৃষ্টি করেছেন যা পরবর্তীতে আলোক বর্তিকা হিসাবে ওয়াক্ফর পথ প্রদর্শন করেছে।
- অষ্টম শতকে মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়াও পথচারীদের ভ্রমণের সুবিধার জন্য বিরকাত বা কূপ সরাইখানা ও ফল বাগান ইত্যাদি সম্পত্তি ওয়াক্ফ করা হতো। পরবর্তীতে ইসলামের আলো মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াক্ফও দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
- কয়সাবা বিন কুলসুম কর্তৃক দানকৃত সম্পত্তিতে হযরত আমর বিন আসর (রহ:) কর্তৃক বায়তুল মাল হতে অর্থ ব্যয়ে প্রথমে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
- মূলতঃ ওয়াক্ত হচ্ছে এক ধরণের সদকা বা দান।
- পবিত্র কোরআনে দান, সদকা, ইনফাক (দান-খয়রাত) ও দাতব্য কাজে ব্যয়ের বিষয়ে অসংখ্য আয়াত নাযিল হয়েছে। পবিত্র কোরআনের ১৯ টি স্থানে সদৃকা এবং ৬৪ টি স্থানে ইনফাক সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে।
ওয়াক্ফ সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের বাণী
পবিত্র কোরআন ও হাদীসে সম্পত্তি ওয়াক্ত করার বিষয়ে আয়াত/বাণী রয়েছে। যেমন-
- ‘তোমাদের সম্পদে ভিখারী ও বঞ্চিতদেরও অধিকার রয়েছে’ (সুরা: আয–যারিয়াত, আয়াত: ১৯)
- ‘কোন পূণ্য নেই পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে; কিন্তু পূণ্য আছে কেউ ঈমান আনলে আল্লাহর উপর, আখেরাতের উপর, ফেরেস্তাগণের উপর, সকল কিতাবের উপর, আর সকল নবী-রসুলগণের উপর এবং আল্লাহ প্রেমে আত্মীয় স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, সালাত কায়েম করলে, যাকাত দিলে, কৃত প্রতিশ্রুতি পূরণ করলে আর অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধে বিভ্রাটে ধৈর্য্য ধারণ করলে। এরাই হলো প্রকৃত সত্য পরায়ণ, আর এরাই মোত্তাকি।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৭৭)
- ‘তারা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে: কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও। যা কিছুই তোমরা ব্যয় করবে তা হবে পিতা- মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যা কিছু উত্তম কাজ কর না কেন, আল্লাহ ‘তা সম্যক অবহিত’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২১৫)
- যারা আল্লাহর রাস্তার স্বীয় ধন সম্পদ বায় করে, তাদের উদাহরণ একটি শষ্য বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়, প্রতিটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ যাচে চান বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন, আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’- (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৬১)
- ‘যারা স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, রাত্রে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব রয়েছে তাদের পালনকর্তার কাছে। তদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা: ২. আয়াত: ২৭৪)
- ‘তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না যে পর্যন্ত না নিজেদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় করবে, আর যা কিছু তোমরা ব্যয় কর, আল্লাহ তা খুব জানেন’। (সুরা: আল–ইমরান, আয়াত: ১২)
- ‘তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই। তবে যে ব্যক্তি নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত করতে, কিংবা সৎকাজ করতে, কিংবা মানুষের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য, তাতে কল্যাণ আছে। যে এসব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত করে, অবশ্যই আমি তাকে মহাপুরস্কার দান করব’। (সুরা: আন–নিসা, আয়াত: ১১৪)
- ‘আত্মীয় স্বজনকে তার হক দিবে এবং মিসকিন ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করবেনা’। (সুরা: বনী–ইসরাঈল, আয়াত: ২৬)
- ‘যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে, যখন নক্ষত্রসমূহ করে পড়বে, যখন সমুদ্র উত্তাল করে তোলা হবে এবং যখন কবরসমূহ উন্মোচিত হবে, তখন প্রত্যেকে জেনে নিবে সে কি অগ্রে প্রেরণ করেছে এবং কি পশ্চাতে ছেড়ে এসেছে।’ (সুরা: আল–ইনফিতার, আয়াত: ১–৫)
ওয়াক্ফ সংক্রান্ত হাদীস
নবী করীম (সাঃ) নিজে দাতব্য কাজ করেছেন এবং এ কাজে সাহাবা একরাম ও উম্মতগণকে উৎসাহ দিয়েছেন। কিশোর বয়সে তিনি মক্কাবাসীর সহায়তায় দাতব্য কাজের জন্য ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সমিতি গঠন করেছিলেন। সম্পত্তি ওয়াক্ফ করার বিষয়ে কয়েকটি হাদিসেও সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন-
- ‘কেউ যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মসজিদ নির্মাণ করে তবে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করে দিবেন।’ মিশকাত
- ‘তোমাদের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত জ্ঞান দান এবং দাতব্য কাজে গড়িমসি বা অবহেলা প্রদর্শন করো না।’ বোখারী ও মুসলিম শরীফ
- ‘মসজিদের জন্য জমি ওয়াক্ফ করা এবং গরীব, ধনী ও মেহমানের জন্য ওয়াক্ফ করার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বোখারী শরীফ ২৫৬৭–৬৮ নং হাদীস
ওয়াফ্ফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- সম্পত্তিতে ওয়াকিফের স্বত্ব-দখল নিরোধ বা রহিত হয়ে ধর্মীয়, দাতব্য কাজে মহান আল্লাহর নামে উৎসর্গই হচ্ছে ওয়াক্ফের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য,
- সামগ্রিক বা আংশিকভাবে ওয়াকিফের পরিবার, ছেলে মেয়ে বা বংশধরদের ভরণপোষণের জন্য:
- ওয়াফ্ফের আয় হতে জীবদ্দশায় নিজের ভরণপোষণ ও ঋণ পরিশোধের জন্য।
- গরীবদের জন্য বা মুসলিম আইনে স্বীকৃত স্থায়ী ধরণের কোন ধর্মীয়, পরিত্র বা দাতব্য উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ
- মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাঁহ, কবরস্থান, মুসাফিরখানা ইত্যাদি নির্মাণ ও পরিচালনা এবং ফকির, মিসকিন, নিঃস্ব ও অসহায় মানুষের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা;
- সর্বোপরি জনসেবা এবং কল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ যা সদকায়ে জারির আমল হিসেবে চিরকাল কাজ করবে;
ওয়াক্ফের আইনগত ভিত্তি
- ১৯১৩ সালে মুসলমান ওয়াক্ফ ভেলিডেটিং এ্যান্ট (The Mussalman Wakf Validating Act, 1913); (মোট ধারা ০৫ টি
- ১৯২৩ সালে মুসলমান ওয়াক্ফ এ্যাক্ট (The Mussalman Wakf Act, 1923); (মোট ধারা ১২ টি)
- ১৯৩০ সালে মুসলমান ওয়াক্ফ ভেলিডেটিং এ্যাক্ট সংশোধিত (The Ammendment of Mussalman Wakf validating Act, 1930), (মোট ধারা ২টি)
- ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াক্ফ আইন (The Bengal Wakf Act, 1934) (মোট ধারা ১৬টি)
- ১৯৬২ সালের ওয়াক্ত অধ্যাদেশ (The Waqf Ordinance, 1962) (মোট ধারা ১০৫ টি)
- ওয়াক্ফ (সংশোধন) আইন, ২০১৩ (Waqfs (Amendment) Act, 2013) (মোট ধারা = ১০টি)
- ওয়াক্ফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১৩ (Waqf (Properties Transfer &
Development) Special act 2013) (মোট ধারা ২৬টি
- ওয়াক্ফ সংশ্লিষ্ট বিধিমালাঃ-
- ১৯৭৫ সালের ওয়াক্ফ প্রশাসন বিধিমালা (The Waqf Administration Rules-1975) (মোট বিধি = ১৭টি)
- ১৯৮৯ সালের ওয়াক্ফ প্রশাসনের কর্মচারী চাকুরি বিধিমালা (The Service Rules of the Public Servants of The Waqf Administration-1989) (মোট বিধি = ৫৯টি)
বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসন
- বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসন একটি স্ব-শাসিত, ইসলাম ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক, সামাজিক কল্যাণকর, দাতব্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যা প্রথমদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, পরবর্তীতে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। বর্তমানে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওয়াক্ফ প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
- ১৯৩৪ সালের বেঙ্গল ওয়াক্ফ এ্যাক্ট মোতাবেক এদেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ সংস্থার সৃষ্টি হয়।
- ১৯৬২ সালের ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ওয়াকিফের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নসহ ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহের তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাই এ সংস্থার মূল লক্ষ্য।
- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে প্রণীত ‘ওয়াক্ফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী ওয়াক্ফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করা এ সংস্থার মূল দায়িত্ব।
বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসনের ভিশন ও মিশন
ডিশন : ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, ধর্মীয়, সামাজিক ও জনকল্যাণ সাধন।
মিশন : ওয়াক্ফ আইন ও অধ্যাদেশ অনুযায়ী ওয়াক্ফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেবামূলক ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ।
সেবামূলক কার্যক্রম
- বিভিন্ন ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহ নিয়মিত যেসব সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-
- সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন মিরপুরস্থ হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (র:) জেনারেল হাসপাতাল বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে:
- হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ (ওয়াক্ফ) বাংলাদেশ দেশের ইউনানী চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে:
- তাছাড়া চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ ওয়াক্ফ এস্টেট, চট্টগ্রাম জেলার হাজী গোলাম রসুল সওদাগর ওয়াক্ফ এস্টেট, কিশোরগঞ্জ জেলার পাগলা মসজিদ ওয়াক্ফ এস্টেটগুলো ধর্মীয় শিক্ষাসহ লিল্লাহ খাতে অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে;
এছাড়া আরো অনেক এস্টেটের জনকল্যাণমূলক বা সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু মোতাওয়াল্লী ও পরিচালনা কমিটির ওয়াক্ফ আইন ও এর সুফল সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব, পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব এবং মাঠ পর্যায়ে নিবিড় মনিটরিং ও তদারকির অভাবে ওয়াক্ফর মহান উদ্দেশ্য যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণে সম্ভাবনাময় ওয়াফ্ফের ভূমিকা
- রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অব্যবহৃত/পতিত ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে পরিকল্পিতভাবে কৃষি, বাণিজ্যিক বা শিল্প সংক্রান্ত কাজের ব্যবহার করা যেতে পারে;
- Islamic Solidarity Fund (ISF) এর অর্থায়নে ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও শিল্প সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে দরিদ্রতা দূরীকরণসহ ওয়াক্ফ এস্টেটের বৃত্তিভোগীদের কল্যাণ। উন্নয়ন করা সম্ভব হবে;
- ঢাকার মগবাজারের বাণিজ্যিক এলাকায় ২০ তলা ভিত বিশিষ্ট ৫ তলা ওয়াক্ত ভবন রয়েছে যার ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম তলার উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারন কাজ চলমান। চলমান কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে ভবনের অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ ২০ তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা গেলে এবং ৩৭ নবাব কাটারাতে অবস্থিত অপর ওয়াক্ফ ভবনটিও উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারন করা গেলে ওয়াক্ফ প্রশাসনের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ওয়াক্ফ প্রশাসনের পরিচিতি বিস্তত লাভ করবে;
- এছাড়া ময়মনসিংহে অবস্থিত রিজভি ওয়াক্ফ এস্টেট এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত হাফেজ মো: ছাদেক ওয়াক্ফ এস্টেট দু’টিতে বহুতল বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হলে ওয়াক্ফ প্রশাসনের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে ওয়াকিফের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ:
- চট্টগ্রাম এবং সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে উচ্চ ফলনশীল ফলদায়ক বৃক্ষ এবং উন্নত জাতের কাঠের বৃক্ষ রোপন করা যেতে পারে যা পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং দিনাজপুরে অবস্থিত ওয়াকফ এস্টেটসমূহে ফলবাগান (Orchard) করা যেতে পারে;
- বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পাদিত ক্যাশ ওয়াক্ফসমূহ ওয়াক্ফ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলে ওয়াক্ফর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটবে এবং ধর্মীয় ও জনকল্যাণে আরো তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। বর্তমান ওয়াক্ফ আইনে ক্যাশ ওয়াক্ফর বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকায় ‘ক্যাশ ওয়াক্ফ’ সংক্রান্ত বিষয়টি আইন সংশোধনের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
- উপকূলীয় অঞ্চলের ওয়াক্ফ ভূমিতে চিংড়ি চাষের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব:
- এছাড়া উপকূল অঞ্চলের সমতল ভূমিতে লবণ চাষের মাধ্যমেও ওয়াক্ফ এস্টেট তথা ওয়াক্ফ প্রশাসনের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে;
- চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ দেশের অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে ফলবান এবং কাঠ জাতীয় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিকল্পিত ভাবে সামাজিক বনায়ন করা যেতে পারে। এছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগানের বিস্তৃতি ঘটানোর মাধ্যমে ওয়াফ্ফের আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে যা দেশের চা শ্রমিক এবং শ্রমজীবি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে;
- সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমানে প্রচলিত ‘ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২’ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজন প্রয়োজন।
- ওয়াক্ফ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ওয়াক্ফর মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পাশাপাশি ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহ সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হবে:
- দেশের অধিকাংশ জনগণ ওয়াক্ফ এবং সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতন নয়। সেকারণে ওয়াক্ফ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (মোতাওয়াল্লী/সভাপতি/সেক্রেটারী) এবং সাধারণ জনগণকে ওয়াক্ফ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য গণমাধ্যমে (রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা ইত্যাদি) প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
- এছাড়া ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লী/সভাপতি/সেক্রেটারীগণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে ওয়াক্ফ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য সম্পর্কে এবং ওয়াক্ফ এস্টেটের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে সজাগ ও দায়িত্বশীল করা যেতে পারে;
মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নে ওয়াক্ফ এর ভূমিকা
- ওআইসি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ন্যায় একটি আন্তর্জাতিক ওয়াক্ফ উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবী। এতে মুসলিম বিশ্বের ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহ কুরআন হাদীসের আলোকে একই নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে একই ভাবধারায় পরিচালিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
- উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ওয়াক্ফ এস্টেটের আয় দ্বারা একই সঙ্গে একই ভাবধারায় ইসলামিক রীতি-নীতি অনুযায়ী ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব, বিভিন্ন দিবস পালন করা সম্ভব হবে।
- অবকাঠামো উন্নয়ন, হর্টিকালচার, লবণ চাষ, মৎসচাষ, বনায়ন, ডেইরী ফার্ম স্থাপন, দীঘি ও কূপ খনন, এতিম ও দরিদ্রদের পূণর্বাসন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্প স্থাপন, ইউনানী ও হারবাল চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়ন করা সহজতর হবে এবং অনুন্নত ও দরিদ্র মুসলিম উম্মাহর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে;
- ইসলামিক দেশ গুলো একে অপরকে আর্থিক, কারিগরি ও তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সহায়তা করে লাভবান হতে পারবে;
- শুধু তাই নয়, এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ভাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, একতা ও মানবতাবোধ সম্প্রসারিত হবে: