একটি লিমিটেড কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করতে বেশ কিছু আইনগত ও নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ জড়িত, যা দেশের ব্যবসায়িক আইন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। নিচে সাধারণত যেসব নথি প্রয়োজন হয় তার একটি বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো। এই গাইডটি অনেক দেশে প্রযোজ্য, তবে নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা অঞ্চলের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সঠিক প্রয়োজনীয়তার জন্য সবসময় স্থানীয় ব্যবসায়িক রেজিস্ট্রার বা একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিন।
১. মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন (MoA)
মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন হলো কোম্পানির প্রাথমিক বিবরণ যেখানে উল্লেখ থাকে:
- কোম্পানির নাম: কোম্পানির আনুষ্ঠানিক নাম, যা হতে হবে অনন্য এবং নামকরণের নিয়মাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- রেজিস্টার্ড অফিস: কোম্পানির নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা।
- কোম্পানির উদ্দেশ্য: ব্যবসার প্রকৃতি এবং কোম্পানি যে কার্যক্রম করবে তার বিস্তারিত।
- লায়াবিলিটি ধারা: শেয়ারহোল্ডারদের দায়বদ্ধতা (সাধারণত তাদের শেয়ারের মূল্যের উপর সীমাবদ্ধ)।
- পুঁজি ধারা: কোম্পানির অনুমোদিত শেয়ার মূলধন এবং এটি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে কিভাবে বন্টিত হবে।
২. আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন (AoA)
আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন হলো কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নীতিমালা এবং পরিচালনার নিয়মাবলী। এর মধ্যে থাকে:
- পরিচালকদের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা: পরিচালকদের নিয়োগ এবং দায়িত্বের নির্দেশিকা।
- ব্যবস্থাপনা কাঠামো: কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া: বোর্ড মিটিং, ভোটিং এবং অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া।
- শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার: শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বাধ্যবাধকতা।
৩. শেয়ারহোল্ডার চুক্তি
এই চুক্তি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে শর্তাবলী নির্ধারণ করে, যেমন:
- মালিকানা কাঠামো: শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারহোল্ডিং প্যাটার্ন এবং ভোটের অধিকার।
- শেয়ার স্থানান্তর: শেয়ার বিক্রি বা স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া।
- বিতর্ক নিষ্পত্তি: শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে মতবিরোধ হলে কিভাবে সমাধান হবে।
- প্রস্থান ধারা: শেয়ারহোল্ডারদের প্রস্থানের পদ্ধতি এবং শর্তাবলী।
৪. পরিচালকদের পরিচয়পত্র ও সম্মতি নথি
কোম্পানির সাথে জড়িত প্রত্যেক পরিচালকের জন্য পরিচয়পত্র এবং সম্মতির নথি প্রদান করতে হয়। এতে থাকতে পারে:
- সরকারি আইডি: পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
- ঠিকানার প্রমাণ: বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ভাড়ার চুক্তি।
- পরিচালক হিসেবে কাজ করার সম্মতি: প্রত্যেক পরিচালকের সম্মতির চিঠি বা ফর্ম।
- ডিজিটাল স্বাক্ষর সনদ (DSC): অনেক দেশে, পরিচালকদের ডিজিটাল স্বাক্ষর প্রয়োজন হয় অনলাইন নথি জমা দেওয়ার জন্য।
৫. নিবন্ধিত অফিসের প্রমাণ
কোম্পানির নিবন্ধিত অফিসের প্রমাণ প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে থাকতে পারে:
- ভাড়ার চুক্তি: যদি অফিস ভাড়া নেওয়া হয়।
- সম্পত্তির মালিকানার নথি: যদি অফিস কোম্পানি বা শেয়ারহোল্ডারদের একজনের মালিকানাধীন হয়।
- অপত্তি সনদ (NOC): যদি অফিস অন্য কারো সম্পত্তিতে থাকে, তাহলে মালিকের থেকে একটি NOC প্রয়োজন হতে পারে।
৬. পরিচালকের পরিচয় নম্বর (DIN)
অনেক দেশে, কোম্পানির পরিচালককে পরিচালক পরিচয় নম্বর (DIN) সংগ্রহ করতে হয়। এটি সরকারের দ্বারা প্রদত্ত একটি ইউনিক আইডি যা কোম্পানির সকল নথিতে ব্যবহার করতে হয়।
৭. শেয়ারহোল্ডার এবং পরিচালকদের রেজুলেশন
কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে একাধিক শেয়ারহোল্ডার থাকলে প্রয়োজন হয়:
- শেয়ারহোল্ডারদের রেজুলেশন: কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন অনুমোদনের জন্য।
- পরিচালকদের রেজুলেশন: নিবন্ধনের জন্য দায়িত্বে কে থাকবে তা নির্ধারণ করার জন্য।
৮. কর রেজিস্ট্রেশন নথি
কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য কিছু কর সম্পর্কিত নথি সংগ্রহ করতে হয়। এতে থাকতে পারে:
- কর সনাক্তকরণ নম্বর (TIN): কোম্পানির কর সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য একটি ইউনিক নম্বর।
- ভ্যাট/জিএসটি রেজিস্ট্রেশন: পণ্য ও সেবার জন্য সংস্থার ভ্যাট বা জিএসটি রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হতে পারে।
- করপোরেট কর রেজিস্ট্রেশন: কোম্পানিকে করপোরেট করের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হবে এবং কর সংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলতে হবে।
৯. মুলধন প্রদানের প্রমাণ
কিছু দেশে শেয়ারহোল্ডারদের দ্বারা মূলধনের প্রদান প্রমাণ হিসেবে নথি জমা দিতে হয়। যেমন:
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট: মূলধন কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে তা প্রদর্শন করার জন্য।
- ব্যাংক সনদ: ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সনদ যাতে কোম্পানির মূলধন প্রদানের প্রমাণ থাকে।
১০. ব্যবসায়িক লাইসেন্স/পারমিট
কোম্পানির কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে কিছু ব্যবসায়িক লাইসেন্স বা পারমিট প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে:
- ট্রেড লাইসেন্স: নির্দিষ্ট ভূ-অঞ্চলে ব্যবসা করার সাধারণ লাইসেন্স।
- শিল্প বিশেষ পারমিট: যেমন পরিবেশগত অনুমতি, খাদ্য লাইসেন্স বা স্বাস্থ্যসেবার অনুমতি।
১১. রেজিস্ট্রেশন ফি এর রসিদ
কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি ফি প্রদান করতে হয়। এর রসিদ বা প্রদানের প্রমাণ নথির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১২. পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (যদি প্রযোজ্য হয়)
যদি পরিচালকদের বা শেয়ারহোল্ডারদের বদলে অন্য কেউ (যেমন আইনজীবী বা কোম্পানি সচিব) রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া পরিচালনা করে, তবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি জমা দিতে হতে পারে, যা তাদের পক্ষে কাজ করার অনুমোদন দেয়।
১৩. মেনে চলার ঘোষণা
কিছু দেশে মেনে চলার ঘোষণা জমা দিতে হয়, যা কোম্পানির প্রবর্তক বা পরিচালক দ্বারা স্বাক্ষরিত হয় এবং এতে বলা থাকে যে, নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল শর্ত পূরণ করা হয়েছে।
১৪. কোম্পানি সিল (প্রযোজ্য হলে)
কিছু দেশে, নিবন্ধনের সময় কোম্পানি সিল প্রয়োজন হতে পারে। এই সিল আনুষ্ঠানিক নথিগুলোর বৈধতা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়।
দেশভিত্তিক বিশেষ নথি:
- ভারতে, একটি পার্মানেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বর (PAN) এবং ট্যাক্স অ্যাকাউন্ট নম্বর (TAN) আবশ্যক।
- যুক্তরাজ্যে, কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য কম্পানিজ হাউস এর সাথে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে এবং ফর্ম IN01 জমা দিতে হবে।
- যুক্তরাষ্ট্রে, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগ (IRS) থেকে নিয়োগকারী সনাক্তকরণ নম্বর (EIN) প্রয়োজন।
আপনার নির্দিষ্ট অঞ্চলের কোম্পানি রেজিস্ট্রার বা আইন পেশাজীবীদের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যাতে আপনি সঠিক নথিগুলি প্রস্তুত করতে পারেন। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া স্থানীয় নিয়মের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে, তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আপনাকে সুষ্ঠুভাবে কোম্পানি নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে।